জাহাঙ্গীর আলম
আমার তামিলনাড়ু ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণীয় অংশ ছিল জয়ললিতা মেমোরিয়াল। এই মেমোরিয়ালটি চেন্নাইয়ের মারিনা বিচে অবস্থিত, যেখানে জয়ললিতা তাঁর রাজনৈতিক সঙ্গী এম.জি.আর-এর (এম.জি. রামাচন্দ্রন) মেমোরিয়ালের পাশেই সমাহিত হন। এই দুটি মেমোরিয়াল একত্রে দাঁড়িয়ে তামিল রাজনীতির দুটি প্রধান চরিত্রের ইতিহাস ও অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। জয়ললিতা একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী থেকে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এক অসাধারণ যাত্রা পাড়ি দেন। তাঁর সংগ্রাম, নেতৃত্ব, এবং সামাজিক উন্নয়নের উদ্যোগ তাঁকে জনগণের হৃদয়ে বিশেষ স্থান দেয়, যা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় এই মেমোরিয়াল ভ্রমণের সময়।
মেমোরিয়ালে প্রবেশের মুহূর্তটি ছিল আমার জন্য বেশ হৃদয়গ্রাহী। মেমোরিয়ালের প্রধান গেটের উঁচু স্তম্ভ, ধবধবে সাদা রঙের মার্বেল পাথর এবং কারুকার্যপূর্ণ নকশা আমার মনে গভীর শ্রদ্ধা এবং মুগ্ধতার অনুভূতি জাগিয়েছিল। মেমোরিয়ালের প্রধান প্রবেশপথটি বিশাল এবং আড়ম্বরপূর্ণ, যার মাধ্যমে একজন বিশিষ্ট নেত্রীর সম্মানকে যথার্থভাবে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রবেশের সময়ই দেখতে পেলাম বিশাল ফুলের বাগান যা পুরো মেমোরিয়ালের চারপাশে একটি সুন্দর এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করেছে। গাছপালা আর ফুলের সাজানো বাগান জায়গাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে এবং সবুজের মাঝে এই সাদা মার্বেল স্থাপত্য এক অনন্য দৃশ্য তৈরি করেছে।
মেমোরিয়ালটি সম্পূর্ণ সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত, যার ফলে একধরণের পবিত্রতার অনুভূতি আসে। জয়ললিতার প্রতিকৃতি, তাঁর জীবন সম্পর্কে নানা তথ্য এবং তাঁর কাজের স্মৃতিচিহ্নগুলো মেমোরিয়ালের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে। মেমোরিয়ালের কেন্দ্রে একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে, যেখানে জয়ললিতাকে প্রার্থনার ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই মূর্তিটি তাঁকে একজন নেতা হিসেবে এবং একইসাথে একজন পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তুলে ধরে।
স্থাপত্যের বিভিন্ন অংশে খোদাই করা কারুকার্য দ্রাবিড় ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে। স্তম্ভগুলি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার এক অনন্য মিশ্রণ দেখা যায়। রাতের আলোয় মেমোরিয়ালটি আলোয় ঝলমল করে ওঠে এবং এটি তখন আরও মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে।
মেমোরিয়ালের একটি বিশিষ্ট অংশে জয়ললিতার জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ের প্রদর্শনী রয়েছে। এতে তাঁর অভিনয় জীবনের কিছু বিখ্যাত মুহূর্ত, রাজনীতিতে তাঁর প্রথম পদক্ষেপ, এবং মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কার্যকালীন সময়ের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি, পুরস্কার এবং জনগণের সঙ্গে তাঁর সংযোগের বিভিন্ন মুহূর্ত এখানে রাখা আছে।
একটি বিশেষ অংশে তাঁর পরিধেয় পোশাক, কিছু পুরস্কার এবং রাজনৈতিক প্রচারণায় ব্যবহৃত জিনিসপত্র রাখা আছে, যা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন এবং তাঁর কর্মজীবনের এক অনন্য ঝলক দেখায়। এখানকার স্মৃতিচিহ্নগুলো দেখে একজন ব্যক্তি হিসেবে এবং নেতা হিসেবে তাঁর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারা যায়।
মেমোরিয়ালে আসা লোকজনের মধ্যে জয়ললিতার প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধার ভাব লক্ষ করেছি। সাধারণ মানুষ তাঁকে শুধুমাত্র একজন রাজনৈতিক নেতা নয়, বরং এক মাতৃস্থানীয়া হিসেবে শ্রদ্ধা করে। তাঁর প্রতি এই ভালবাসা এবং সম্মান এখানকার প্রতিটি কোণে উপলব্ধি করা যায়।
যেখানে যেখানে দর্শনার্থীদের সাথে কথা বলেছি, সবাই তাঁর সম্পর্কে আবেগপূর্ণ কথা বলেছেন। তাঁদের কথায় “আম্মা” হিসেবে পরিচিত জয়ললিতার সংগ্রাম, অবদান এবং তার স্বপ্নের তামিল নাড়ুর গল্প বারবার উঠে এসেছে। তাঁর জনকল্যাণমূলক কাজ যেমন—বিনামূল্যে খাবার, শিক্ষার সুযোগ, এবং নারীদের ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত উদ্যোগ—তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের এই শ্রদ্ধার মূল কারণ হিসেবে উঠে আসে।
আমি মেমোরিয়ালের চারপাশে ঘুরে বিভিন্ন ছবি তুলেছি। বিশেষ করে মেমোরিয়ালের কেন্দ্রীয় অংশে জয়ললিতার স্মৃতিস্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার মুহূর্তটি ছিল বিশেষ। স্থাপত্যের কারুকার্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবিগুলো তোলা একধরনের আনন্দের অনুভূতি দেয়।
মেমোরিয়ালের বাইরে কিছু দোকান আছে, যেখানে তামিল নাড়ুর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং জয়ললিতার ছবি সংবলিত পোস্টকার্ড, টোকেন এবং অন্যান্য স্মৃতিচিহ্ন বিক্রি করা হয়। আমি নিজেও কিছু স্মৃতিস্বরূপ সংগ্রহ করেছি যা আমার এই অভিজ্ঞতাকে আরো স্মরণীয় করে রেখেছে।
আমার দেখা জয়ললিতা মেমোরিয়াল শুধু একটি স্মৃতিসৌধ নয়, এটি তামিল নাড়ুর গর্ব এবং ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি একটি অনন্য স্থান যেখানে ইতিহাস, নেতৃত্ব, এবং একজন নারীর সংগ্রামের গল্প একসাথে মিশে আছে।
এখানে এসে আমি শুধু জয়ললিতার জীবন ও নেতৃত্ব সম্পর্কে জানলাম না, বরং একজন মানুষ হিসেবে তাঁর জনকল্যাণমূলক কাজ, তাঁর স্নেহময়ী আচরণ এবং রাজনীতিতে তাঁর দৃঢ় নেতৃত্বের সাক্ষী হলাম। মেমোরিয়ালের প্রতিটি কোণ থেকে এটি স্পষ্ট যে জয়ললিতা তামিল জনগণের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন, এবং এই মেমোরিয়াল সেই গভীর ভালবাসার নিদর্শন।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত।